
সাইফুর মিনা ★
বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য সুন্দরবন । বাংলাদেশের মানচিত্রকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদার আসন দিয়ে অলংকৃত করেছে সুন্দরবন। বাংলায় সুন্দরবন এর আভিধানিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা , যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে সমুদ্র বন বা চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ারসমৃদ্ধ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে স্থিত। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনভূমির মৃত্তিকা ও বাস্তুসংস্থান অনন্য এবং এ বনভূমিতে জোয়ারভাটার কারণে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার প্রভাব সুস্পষ্ট। এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্যও অনন্য। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে।
১৯০৩ সালে মি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় সুন্দরবনে। প্রায় ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে কেবল সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি প্রজাতি। এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া। এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছও প্রাকৃতিক ভাবে জন্মে। সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া আছে প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির, এদের আনুমানিক সংখ্যা ২০০। সাপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে উল্লেখযোগ্য। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী অধিকাংশ পাখিই স্থানীয় বা আবাসিক। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্র্যও সীমাহীন। সর্বশেষ জরিপ মোতাবেক সুন্দরবনে ১০৬ টি বাঘ ও ১,০০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ চিত্রা হরিণ ও ২০,০০০ বানর রয়েছে। গবেষণা মতে এই প্রানীবৈচিত্র্যের মধ্যে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী বর্তমানে হুমকির মুখে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বন অধিদপ্তর তথা সরকার কর্তৃক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ সালে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড কে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিধায় ১৯৯২ সালে সুন্দরবন ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।