
বায়াত্তর বছর বয়সে খসে পড়ে যে নক্ষত্রটি, যাঁর স্মৃতি আর কীর্তি আজও ঘুরে বেড়ায় বাংলার আকাশে বাতাসে । স্মৃতির পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করে সেই নক্ষত্রটি, সে নাম শামসুদ্দিন কায়েস। পারিবারিক ডাকনাম ছিল আশা। যাঁর জন্ম ১৯৪০ সালের ১৬ জানুয়ারি। সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়ার কৃতি সন্তান। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা যদিও কুষ্টিয়া, কিন্তু মন-মননে সাংস্কৃতিকে ভালোবেসে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাটিয়েছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। মাতা শামসুন্নাহার ছিলেন একজন সু- গৃহিনী এবং পিতা রমজান আলি শেখ যেমন একজন সফল আইনজীবী ছিলেন, তেমনই সাংস্কৃতিক জগতে ছিলেন উচ্চ শিখড়ে।
শামসুদ্দিন কায়েসের স্কুল জীবন কেটেছে কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাই স্কুলে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে।পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে লেখাপড়া করেন।
অত্যন্ত ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি তাঁর ঝোঁক চাপে। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে তিনি মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেছিলেন। তিনি তাঁর পিতার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অধিকন্তু কুষ্টিয়ার পরিমল নাট্যসমিতির অনুপ্রেরণায় একনিষ্ঠভাবে অভিনয় শুরু করেন কায়েস । তাঁর অভিনয়ের শিক্ষাগুরু ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা এস, এম, ওয়াহিদ (জাঁহাপনা)। তাঁর অভিনয়ের নিজ দক্ষতার কারণে ষাটের দশকে রেডিও এবং কলিম শরাফীর হাত ধরে টেলিভিশনে নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। সেই সাথে সুযোগ মিলে যায় চলচ্চিত্রে। নায়ক হিসাবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র " ঘূর্ণিঝড় "। তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন কবরী।পরবর্তীতে ভাড়াটে বাড়ি, বাংলার চব্বিশ বছর,কুমারী মন,রক্ত শপথ,মন নিয়ে খেলা সহ বেশকিছু ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন কায়েস। তাঁর বিপরীতে নায়িকা হিসাবে অভিনয় করেছিলেন সুজাতা,অলিভিয়া, কবিতার মতো জনপ্রিয় সব নায়িকা । তিনি খলনায়কের চরিত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যতিক্রম চরিত্রে অভিনয় করে একজন দক্ষ এবং গুণী অভিনেতা হিসাবে দর্শক মহলে প্রসংশিত হয়েছিলেন। শামসুদ্দিন কায়েস অভিনীত ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র গুলোর মধ্যে ঘূর্নিঝড়,পাগলা রাজা,বন্দিনী, ঝড়ের পাখি, রাজ দুলারী,মৌচোর,ভাঙ্গাগড়া,জোশ,অশিক্ষিত, বন্দুক , সাম্পানওয়ালা,রেশমি চুড়ি, বানজারান, সাহেব,ছুটির ঘন্টা,রজনীগন্ধা, মহেশখালীর বাঁকে,ইশারা, অভিমান,রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত,অঙ্গার,নাগ পূর্ণিমা ,লাল বেনারসি, বৌরাণী,মাটির মায়া, নোলক,রাজকুমারী চন্দ্রবান,আখেরী নিশান, মা ও মেয়ে,নিঃস্বার্থ, রাই বিনোদিনী,লড়াকু,রাজভিখারী, যুবরাজ,পুরস্কার,
উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রায় পাঁচ শতাধিক ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন।
তাঁর অভিনীত মঞ্চস্থ উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও ঐতিহাসিক নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যাকবেথ,ওথেলো, দেবদাস, সিঁদুর নিওনা মুছে,একটি পয়সা,বৌদির বিয়ে,মায়ামৃগ, এরাও মানুষ,কালিন্দী,
সিরাজদ্দৌলা,টিপু সুলতান, হায়দার আলী ও শাজাহান। তিনি সেই সময় টানা ১৫ বছর দাপটের সাথে নাটকে অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপিয়ে দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন।
শামসুদ্দিন কায়েস " শুভরাত্রি " নামক একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন। উক্ত ছবিতে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দেবদাস খ্যাত নায়ক বুলবুল আহমেদ। বিপরীতে নায়িকা হিসাবে অভিনয় করেছিলেন শ্যামলী।
অত্যন্ত সদালাপী সদাহাস্যজ্বল সরল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন কায়েস। একজন গুণী অভিনেতা হিসাবে দর্শকমহলে কুড়িয়েছিলেন প্রচুর প্রসংশা।
নাট্যঅঙ্গন এবং চলচ্চিত্রে তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একজন সফল অভিনেতা হিসাবে কায়েসও স্মরণীয় -বরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে একজন।
এই গুণী শিল্পী ২০১২ সালের ২২ ডিসেম্বর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) প্রয়াত এই গুণী অভিনেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
লেখকঃ কবি ও সাংবাদিক